এবার পাকিস্তানের ‘পারমাণবিক ছাতার’ নিচে সৌদি, পাল্টে যাবে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের হিসাব-নিকাশ



কাতারে ইসরায়েলের হামলার এক সপ্তাহের মাথায় সৌদি আরব ও পাকিস্তান একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ চুক্তি কার্যত ইসলামাবাদের ‘পারমাণবিক ছাতার’ আওতায় উপসাগরীয় রাজতন্ত্র সৌদিকে আনার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। একই সঙ্গে এটি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে একটি স্পষ্ট বার্তা-কাতারে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ায় রিয়াদ এখন বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে নতুন পথে হাঁটছে।


বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রিয়াদে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ চুক্তিতে সই করেন। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যে কোনো একটি দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ উভয়ের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবে গণ্য হবে।’


চুক্তির উদ্দেশ্য হলো ‘দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার দিকগুলো উন্নত করা এবং যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ শক্তিশালী করা।’ এতে প্রায় আট দশকের পুরোনো ঐতিহাসিক অংশীদারত্ব, কৌশলগত স্বার্থ ও ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্কের কথা তুলে ধরা হয়েছে।


রিয়াদে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ চুক্তিতে সই করেন।

রিয়াদে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ চুক্তিতে সই করেন।


সৌদি আরব ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। পাকিস্তানি সেনারা প্রথম ১৯৬০-এর দশকে মক্কা-মদিনার নিরাপত্তা রক্ষায় সৌদিতে যায়। ইরানের ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে এই সম্পর্ক আরও গভীর হয়। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে সৌদি আরব অর্থায়ন করেছিল, যার ফলে বহু বছর ধরে অনুমান করা হচ্ছিল, প্রয়োজনে রিয়াদ ইসলামাবাদের পারমাণবিক ছাতার আওতায় আসতে পারে।


বিশ্লেষকদের মতে, এ চুক্তির সময়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ইসরায়েল বর্তমানে গাজা, ইরান, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে বহুমুখী যুদ্ধে জড়িয়েছে। আর উপসাগরে কাতারের ওপর সরাসরি হামলা করে প্রথমবারের মতো অঞ্চলটির নিরাপত্তা সমীকরণে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।


সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি তাই স্পষ্টতই ইসরায়েলের প্রতি একটি জবাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিকল্প সুরক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় রিয়াদের কার্যকর প্রচেষ্টা।


যুক্তরাষ্ট্র এখনও এ চুক্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি। অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা চুক্তির প্রভাব ‘জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার ওপর কী পড়তে পারে তা খতিয়ে দেখবে।’ ভারত সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক অংশীদার হলেও পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা তাদের জন্য নতুন উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।


এদিকে, ইরান চুক্তির আগেই তেহরানের শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আলি লারিজানিকে সৌদি আরবে পাঠায়। ২০২৩ সালের চীন-সংশ্লিষ্ট মধ্যস্থতায় রিয়াদ-তেহরান সম্পর্কের বরফ গললেও, নতুন এই প্রতিরক্ষা জোটকে ইরান ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইছে, যার অংশ হিসেবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অনুমতি চেয়েছে। যদিও সৌদি আরব পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি)-তে সইকারী দেশ এবং নিজস্ব অস্ত্র কর্মসূচি চালায় না। যদিও যুবরাজ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন-ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানালে সৌদিও সেই পথে এগোবে।


সাম্প্রতিক চুক্তি তাই উপসাগরে নতুন কৌশলগত বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। এটি একদিকে সৌদি আরবের জন্য পাকিস্তানের সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীলতার প্রতিফলন, অন্যদিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে শক্ত বার্তা যে রিয়াদ প্রয়োজনে নতুন নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে প্রস্তুত।


সৌদি আরব পাকিস্তানের পারমাণবিক ছাতার নিচে চলে গেলে এটি শুধু ইরান নয়, গোটা উপসাগরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই পাল্টে দেবে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ভারসাম্য এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করবে। সেই সঙ্গে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের এ সর্বাত্মক ঘনিষ্ঠতা ভারতেও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। পারমাণবিক অস্ত্রের নতুন এই সমীকরণ যদি রিয়াদকে জড়িয়ে ফেলে তবে দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তায় শক্তিশালী প্রভাববলয় হিসেবে উত্থান হবে পাকিস্তানের।


নতুন এই চুক্তি তেহরানের জন্যে প্রচ্ছন্ন হুমকি। সৌদি যদি পরমাণু প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করে নেয়, তবে গোটা অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে।


সেই সঙ্গে ওয়াশিংটনের জন্য এই নিরাপত্তা চুক্তি খুব স্বস্তিদায়ক নয়। সৌদি বরাবরই মার্কিন নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করত। এখন যদি পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে যায়, তবে মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে মার্কিন প্রভাববলয় স্পষ্টতই কমে যাবে।


এই মুহূর্তে এটি পাকিস্তানের জন্য এক বিশাল কূটনৈতিক সাফল্য। রিয়াদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সামরিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক এবার সর্বোচ্চ কৌশলগত নিরাপত্তার পর্যায়ে পৌঁছাল। তবে পাকিস্তানের জন্যও দায়িত্ব বাড়লো। কারণ এর ফলে বিশ্ব মোড়লদের মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারী এখন পাকিস্তানের ওপর আরও বেশি পড়বে। যা হয়তো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পর্যায়ে চলে যেতে পারে।

Countdown Timer
00:01

Post a Comment

Previous Post Next Post